"আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস- ২০২৩ উপলক্ষ্যে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ও আইকম বাংলাদেশ ন্যাশনাল কমিটি কর্তৃক যৌথভাবে আয়োজিত সেমিনারে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সন্মানিত সচিব জনাব খলিল আহমদের সুচিন্তিত অভিমত"
তারিখ: ১২ জুন ২০২৩
ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, জাপান এবং যুক্তরাজ্যের অনেক জাদুঘরে ঘুরে দেখার আমার সৌভাগ্য হয়েছিল। মনে পড়ে যুক্তরাজ্যে একদিন বিভিন্ন ধরনের পাখির জাদুঘর দেখেছিলাম। সেখানে বিভিন্ন কেমিক্যাল মাখিয়ে পাখিগুলোকে প্রদর্শন করা হচ্ছে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে অনেক যত্ন সহকারে সম্পদগুলোকে শৈল্পিকভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছিল। যুক্তরাজ্যে ক্যাসেলসমূহ খুবই জনপ্রিয়, হাজার হাজার মানুষকে দেখেছি সেখানে পরিদর্শন করতে আসে। ২০১৯ সালে জার্মানিতে একটি জাদুঘর দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। দক্ষিণ কোরিয়াতে কয়েন মিউজিয়াম দেখেছি যেখানে বিশ্বের প্রায় সব দেশেরই কয়েন এবং বিভিন্ন ধরনের মুদ্রা রয়েছে। মনে পড়ছে ২০০৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়াতে দেখেছি একটি ছোট্ট মিউজিয়াম যেখানে বলা হচ্ছিল এক সময় তারা দরিদ্র ছিল, এখন দারিদ্র্যকে মিউজিয়ামের নিয়ে এসেছে। ২০১৫ সালে গিয়েছিলাম বেলারুশের ওয়ার মিউজিয়ামে এবং এই মিউজিয়ামের অসাধারণ স্থাপত্যশৈলী এখনো আমার মনে দাগ কাটে। আমি লক্ষ্য করেছিলাম এই সকল মিউজিয়ামে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের আধিক্য রয়েছে। মিউজিয়ামের প্রতি আকর্ষণ থাকায় আজ খুব মনোযোগ সহকারে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে বিশেষজ্ঞ বক্তাদের বক্তব্য শুনছিলাম। তাদের বক্তব্য এবং লেখনি থেকে ধারণা নিয়ে এখানে উপস্থাপনের চেষ্টা করলাম।
আজ ১২ জুন ২০২৩ তারিখে ১৮ মে আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস উপলক্ষে 'জাদুঘরের প্রদর্শনী ও নিদর্শনকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা: স্থায়িত্ব ও সমৃদ্ধি' শীর্ষক এক সেমিনারের আয়োজন করা হয় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ভবনে। আন্তর্জাতিক জাদুঘর কাউন্সিলের বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক জনাব মোঃ কামরুজ্জামান, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের মহাপরিচালক জনাব মোঃ জসিম উদ্দিন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক জনাব মো: জুলকারনাইন, টাকা জাদুঘরের কিউরেটর ড. আছিয়া খানম, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জনাব চন্দন কুমার দে এবং সেমিনারের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপক মোঃ আমিরুজ্জামান সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন। সেমিনারের আগে ২০০০ বছরের পুরানো ২০টি কয়েন দিয়ে একটি স্থায়ী প্রদর্শনীর উদ্বোধন করা হয়।
আজকের সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপক এবং আলোচকগণ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয় উপস্থাপন করেন। জাদুঘরের সংজ্ঞা কী, জাদুঘর কেমন হওয়া উচিত, শিক্ষার একটি অন্যতম মাধ্যম জাদুঘর হতে পারে এবং জাদুঘরের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
জাদুঘর হচ্ছে একটি জাতির ইতিহাস ঐতিহ্য শিক্ষা সংস্কৃতি দেশ-বিদেশের দর্শকের নিকট তুলে ধরতে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। ২১ শতকের জাদুঘর স্মৃতি, নন্দনিক, উত্তরাধিকারের দলিল, বুদ্ধিদীপ্ত নব্য চেতনার বাহক, সংস্কৃতি ও সমাজের জ্ঞানভাণ্ডার। জাদুঘরে বস্তুগতভাবে উপস্থাপিত সংস্কৃতি মনন, প্রাসঙ্গিকতা, ব্যবহার, বিশ্বাস, যুক্তি, নন্দনতত্ত্ব এবং বিশ্ব মানবের অর্জিত জ্ঞান দ্বারা ব্যাখ্যায়িত হওয়া উচিত এবং তখনই জাদুঘরের শিক্ষা সমাজের বহুমুখী সাংস্কৃতিক উন্নয়নে, জাতীয় চেতনা বৃদ্ধিতে, জনগোষ্ঠীর কল্যাণে, টেকসই সমাজ গঠনে বর্তমান যুগের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে। জাদুঘরে শুধু গ্যালারি প্রদর্শনই হয় না, প্রদর্শনীতে থাকে জনশিক্ষা এবং শিক্ষামূলক কার্যক্রম। জাদুঘরকে তাই গণবিশ্ববিদ্যালয় বলা হয়।
আন্তর্জাতিক জাদুকর কাউন্সিল কর্তৃক জাদুঘর দিবস উপলক্ষে একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয় সেটি হচ্ছে 'জাদুঘর, স্থায়িত্ব ও সমৃদ্ধি'। ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক জাদুঘর কাউন্সিল কর্তৃক টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য মাত্রার ৩, ১৩ ও ১৫ কে ফোকাস করা হয়েছে।
লক্ষ্য ৩ এর মাধ্যমে বৈষয়িক স্বাস্থ্য ও সুস্থতার মাধ্যমে কল্যাণ ও সমৃদ্ধিকে গুরুত্ব প্রদান করা হয়। মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতাকে জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্তির জন্য জাদুঘরসমূহের বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচির নির্ধারণের সুযোগ রয়েছে। লক্ষ্য ১৩ এর মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে মানুষকে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কর্মসূচি নির্ধারণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রভাবগুলো জরুরিভাবে মোকাবেলার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণে সামাজিক গোষ্ঠীর করণীয় সম্পর্কে জাদুঘরসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। জাদুঘরের প্রাচীন সাংস্কৃতিক নিদর্শন ও স্থানগুলোর ল্যান্ডস্কেপ অধ্যয়নের মাধ্যমে জলবায়ুর প্রভাব বোঝার এবং বর্তমানে ও ভবিষ্যতের প্রজন্মের সুরক্ষার চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার একটি সমন্বিত কর্ম পরিকল্পনা প্রচেষ্টায় ভূমিকা রাখা সম্ভব। লক্ষ্য ১৫ এর মাধ্যমে স্থলজ বাস্তুতন্ত্রের টেকসই ব্যবহারের সুরক্ষা, পুনরুদ্ধার এবং প্রচার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর প্রশস্থ করা এবং জীববৈচিত্রের ক্ষতি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য জাদুঘর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
জাদুঘর কেমন হওয়া প্রয়োজন সে বিষয়ে কয়েকটি ধারণা দেওয়া হয়। জাদুঘর তথা প্রদর্শনী কক্ষের স্থাপত্য পরিকল্পনা অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জাদুঘরের সংগ্রহের ধরন এবং বিষয়বস্তুর সাথে সামঞ্জস্য রেখে মিউজোগ্রাফিক ধারণা প্রাধান্য দিয়ে স্থাপত্য কাঠামো তৈরি করা খুবই প্রয়োজন। স্থাপত্য কাঠামোতে প্রদর্শনী কক্ষ, দর্শক সুবিধা, আলোক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, পরিবেশের প্রভাব নিয়ন্ত্রণ, সংরক্ষণ, ল্যাবরেটারি, গুদাম ব্যবস্থাপনা, নিদর্শনের প্রকৃতি প্রদর্শনী পরিকল্পনা ইত্যাদি বিষয়ে বিবেচনায় নিয়ে জাদুঘরের স্থাপত্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হয়।
প্রদর্শনী পরিকল্পনায় কয়েকটি বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়, যেমন স্টোরি লাইন তৈরি করা ও স্টোরি লাইনের ওপর ভিত্তি করে স্থান নির্বাচন ও নকশা তৈরি করতে হয়। জাদুঘরে প্রদর্শনী কক্ষে চার ধরনের শোকেস ব্যবহার করা যেতে করা পারে, যেমন, দেওয়াল শোকেস, পার্শ্ব দেওয়াল শোকেস, মেঝে শোকেস ও টেবিল শোকেস। জাদুঘরের ভিতরে প্রাকৃতিক আলোর পাশাপাশি কৃত্রিম আলো ব্যবহার করলে দর্শক বেশি স্বস্তি পায়। জাদুঘরের তিন ধরনের লেবেল ব্যবহার করা প্রয়োজন, যেমন, নিদর্শন লেবেল, মাস্টার লেবেল এবং কি লেভেল। যেহেতু প্রত্নসম্পদসমূহ অবক্ষয়ের মধ্যে থাকে সেহেতু তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ একটি অপরিহার্য বিষয়।
বর্তমানে তথ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নের কারণে ভার্চুয়াল জাদুঘর প্রদর্শনীর ব্যবস্থা থাকা খুবই প্রয়োজনীয়। আধুনিক জাদুঘর থ্রিডি প্রিন্ট, ৩৬০ ডিগ্রি প্রেজেন্টেশন, বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারসহ বৈশ্বিকগ্রামে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন রয়েছে। জাদুঘরের স্থায়ী ব্যবস্থাপনা কাঠামোতে ভ্রাম্যমান প্রদর্শনী অন্তর্ভুক্ত করা, যাতে করে গ্রাম বাংলার মানুষও জাদুঘর পরিদর্শন করে শিক্ষা অর্জন করতে পারে। জাদুঘরের স্কুল কর্মসূচি থাকলেই দেশের ছেলেমেয়েরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে পারে। বর্তমানে কথ্য ইতিহাস ও স্মৃতিচারণমূলক লিখনের মাধ্যমে জাদুঘরকে সমৃদ্ধ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের কথ্য ইতিহাস সংরক্ষণ করা হলে একদিন এগুলো মূল্যবান সম্পদ হিসেবে শিক্ষনীয় বিষয় হবে। জাদুঘরে চলচ্চিত্র ও ডকুমেন্টারি প্রদর্শন, নিদর্শন কেন্দ্রিক প্রতিযোগিতা, অনলাইন প্রকাশনা, অনলাইন লাইব্রেরী চালুকরণ, অনলাইন প্লাটফর্মে সেমিনার, আলোচনা সভা, গবেষণা, প্রশিক্ষণ কর্মশালা, বিশেষ বক্তৃতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের জাদুঘর পরিদর্শন কর্মসূচির আয়োজন করে জাদুকরকে কার্যকর করা যেতে পারে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে প্রায় ২২ টি জাদুঘর রয়েছে। আমাদের চেষ্টা থাকবে এই জাদুঘরগুলোকে আধুনিক পর্যায়ে উন্নীত করা।